মহামায়ে জগন্মাতেঃ কালীকে
গৃহান বনন্দনং দেবী নমস্তে পরমেশ্বরী।’
দীপাবলির রাতে অর্থাৎ কার্তিক মাসের অমাবস্যার মহা নিশীথে মহাদেবী, মহাকালী এই ভূমণ্ডলে আবির্ভূত হন। এটাই তার আবির্ভাবের তিথি। কালী বিলাসতন্ত্রে আছে-
‘কার্তিকে কৃষ্ণ পক্ষে তু পক্ষদশ্যাং মহানিশি।
আবির্ভূতা মহাকালী যোগিনী কোটিভিসহা।’
আর এ কারণেই কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে শাক্ত সম্প্রদায় দেবী মহাকালীর পূজা করে থাকেন। উল্লেখ্য, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে গুণ অনুসারে শৈব, শাক্ত, গানপত্য ও বৈষ্ণব, ভিন্ন ভিন্ন ধারায় ভগবানের আরাধনা করা হয়ে থাকে। স্কন্ধ পুরাণের বিষ্ণু খণ্ডে (৯.৬১) দীপাবলির মাহাত্ম্যে বর্ণিত আছে, মহারাত্রীঃ সমুৎপন্না চতুর্দশ্যাঃ মুনীশ্বরঃ।
দক্ষিণাকালী চতুর্ভুজা। তার চার হাতের একেকটিতে রয়েছে খড়গ, রয়েছে অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, বর ও অভয় মুদ্রা। গলায় রয়েছে অসুরের মুণ্ডের মালা। সাধক কবি গেয়েছেন-
‘আদিভূতা সনাতনী, ব্রহ্মরূপা শশীভালি
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?’
মহাদেবী তো পরমেশ্বর ভগবানেরই বহিরঙ্গা শক্তি, তিনি তো অনাদি-অনন্তকালের। সৃষ্টির আদি থেকেই তার গলায় মুণ্ডমালা। মুণ্ড বলতে এখানে বর্ণ অক্ষর মালাকে বোঝানো হয়েছে। অ থেকে ক্ষ পর্যন্ত পঞ্চাশটি অক্ষরের মাধ্যমে আমরা জাগতিক জ্ঞান লাভ করি।
এই জ্ঞান আসলে অজ্ঞানতা। আমরা অজ্ঞানতা বা মায়ার কারণে আসলকে ভুলে থাকি। আর এই অজ্ঞানতার কারণেই মাতৃ সান্নিধ্য আমরা পাই না। মা হচ্ছেন স্বয়ং প্রজ্ঞা।
তার সান্নিধ্যে পৌঁছতে গেলে পাপ-পুণ্য, ধর্মাধর্ম, জ্ঞান-অজ্ঞান সবকিছুকে ত্যাগ করে একেবারে নগ্ন হয়ে পৌঁছতে হবে। নগ্ন মানে উলঙ্গ নয়, এখানে মায়ার আবরণকে সরিয়ে ফেলে নিঃস্ব হয়ে প্রজ্ঞার মধ্যে লীন হতে হবে, অর্থাৎ শুদ্ধা ভক্তির দ্বারা মোক্ষ লাভ। আর এ জন্যই মায়ের গলায় মুণ্ডমালা।
দেবীর গায়ের বর্ণ কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় আলুলায়িত কেশ। কর্মের মাধ্যমে লোকশিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি রণচণ্ডী মূর্তিতে অত্যাচারী অসুরদের নিধনে ব্যস্ত, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য।
তার অসুর নিধন যজ্ঞের উন্মত্ততায় পৃথিবীর মহাপ্রলয় যখন আসন্ন, তখন সব দেবতা নিরুপায় হয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হয়ে করুণভাবে প্রার্থনা করেন, যেন এ যাত্রায় পৃথিবীকে মহাপ্রলয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন।
তখন দেবাদিদেব মহাদেব সবকিছু বিবেচনা করে দেবীর চলার পথে একটি লীলা করেন। তখন রণচণ্ডীদেবী চলতে চলতে তার পায়ের নিচে দেবাদিদেব মহাদেবকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ রণেভঙ্গ দেন এবং এহেন উন্মত্তার জন্য লজ্জিত হন।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই ধরাধামে অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক হিসেবে এই দিনে মা-কালীর পূজা করা হয়। তিনি জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিনী এবং মাঘ মাসে রটন্তীকালী রূপেও পূজিতা হন।
দেবী কালিকার অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। বিভিন্ন পুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রে দেবী কালিকার বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। এর প্রধান কয়েকটি হল দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী (বরদেশ্বরী), সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, মহাকালী, রক্ষাকালী ইত্যাদি।
বিবিধ রূপের দেবী কালিকা বিভিন্ন মন্দিরে আবার বিভিন্ন নামে পূজিত হন। যেমন- ব্রহ্মময়ী, ভবতারিনী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী ইত্যাদি। এই বহুরূপের মধ্যে দক্ষিণাকালী রূপে বিগ্রহই সর্বাধিক পূজিতা হন ভক্তদের দ্বারা।
‘জয়ন্তী মঙ্গলাকালী ভদ্রাকালী কৃপালিনী
দুর্গা শিবা সমাধ্যার্ত্রী সহাঃ সধাঃ নমোহস্তুতে।’
নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তার বংশধররা সনাতন ধর্মের সব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পূজার প্রচলন করেন ও তা জনপ্রিয় করে তোলেন। কালীপূজা ও দীপাবলি একই দিনে অনুষ্ঠিত হলেও মূলত দুটি পূজারই পৃথক ইতিহাস রয়েছে।
এবার আসি দীপাবলির কথায়, দীপাবলি বা দেয়ালী সারা পৃথিবীতে আলোর উৎসব হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকেন।
ত্রেতাযুগে পিতৃভক্তির প্রতীক পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র জগৎবাসীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য সীতাদেবীসহ চৌদ্দ বছর বনবাসলীলা ও অশুভ মহাশক্তি রাবণের সঙ্গে যুদ্ধলীলা করেন। শ্রীরামচন্দ্রের চৌদ্দ বছরের দীর্ঘ বিরহে অযোধ্যাবাসী যখন কাতর হয়েছিলেন, তখন তিনি বনবাসলীলা শেষ করে ভক্ত হনুমানের মাধ্যমে ভ্রাতা ভরতের কাছে অযোধ্যা নগরীতে ফিরে আসার বার্তা প্রেরণ করেন।
অশুভ পরাশক্তিকে নাশ করার পর দামোদর মাসে (কার্তিক মাস) কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে তিনি অযোধ্যা নগরীতে তার প্রাণপ্রিয় ভক্তদের মাঝে ফিরে আসবেন। তাই অযোধ্যাবাসী তাদের প্রাণপ্রিয় শ্রীরামচন্দ্রকে স্বাগত জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।
কারণ তিনি প্রবেশ করে ধন্য করবেন এই নগরী। শ্রীরামচন্দ্রের আগমন বার্তা পেয়ে রাজা ভরত সমগ্র নগরে উৎসবের ঘোষণা দিলে সমগ্র নগরী আলোর উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে।
সব অমঙ্গল, অকল্যাণ দূর হবে এই শুভ কামনায় পথে পথে, বাড়িতে বাড়িতে, গাছে গাছে সর্বত্রই মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন অযোধ্যাবাসী। শ্রীরামচন্দ্র অমাবস্যার অন্ধকারে প্রত্যাবর্তন করবেন, তাই সমগ্র অযোধ্যা নগরী আলোর প্রদীপ দিয়ে সাজানো হল যেন তাদের প্রাণপ্রিয় শ্রীরামচন্দ্র অমাবস্যার অন্ধকার দূর করে মঙ্গলময় আলোকে নগরীতে প্রবেশ করেন।
সেই থেকে এই শুভ দিনটিতে অশুভ অন্ধকার দূর করার লক্ষ্যে আলোর প্রদীপ জ্বালানো হচ্ছে। এই শুভ দিনটিতে অনেক স্থানে লক্ষ্মীপূজাও অনুষ্ঠিত হয়।
লোকশিক্ষা দেয়ার জন্য অশুভ শক্তির প্রতীক, মহাপরাক্রমশালী অসুর রাবণকে বিনাশ করে এই পুণ্যলগ্নে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তার প্রিয় ভক্তদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন।
এই মহানিশিথে ভগবানের বহিরঙ্গা শক্তি, মা দুর্গার বিশেষ রূপ মহাদেবী-মহাকালী অত্যাচারী অসুরদের নিধন করে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করেন। আর তাই অশুভ শক্তি বিনাশের আনন্দই এই মঙ্গলময় আলোক উৎসব দীপাবলি বা কালীপূজা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন